একান্ত ভাবনা

ধরম নীতি, রাজনীতি, অরথনীতি, সমজনীতি ইত্যাদি

রবিবার, ২ অক্টোবর, ২০১৬

জীবনের জন্যই জীবন


কর্তব্যরত সেবিকা
সীমার সাথে যে আমার আবার দেখা হবে তা আমি কোন দিন কল্পনাও করতে পারিনি।

আমি যে সীমার কথা বলছি সে, আমি আমরা ২০/২৫ বছর আগে এক সাথে পড়াশুনা করতাম।

এতদিন পর আমি পুরোপুরই ওকে ভুলে গিয়েছিলাম। ওকে ঘিরে কোন স্মৃতির কথা মনে করাও ছিল দুঃসাধ্যের মত কোন বিষয়।

তবে যা আমার মনে ছিল, যা হয়তো আমি সহজেই মনে করতে পারি তা হচ্ছে ওর কমনীয় মুখ মন্ডল, মিষ্টি মিষ্টি কথা যা হাসি-আনন্দে বা সুখে-দুঃখে সব সময় বলত। আর ওর বন্ধু সূলভ আচরণ বিনম্র ব্যবহার।

কেন জানি আজও আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় সীমা এই সমস্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো উপরিস্থিত স্বর্গ ভান্ডার থেকেই লাভ করেছিল।


সব ছাত্র-ছাত্রীরা ওকে খুব পছন্দ করত। শিক্ষকরাও খুবই ভালবাসতেন ওকে।

ওর জন্মটাও ছিল আশির্বাদ স্বরুপ। কেন না ওর মা-বাবা উভয়ই শিক্ষিত ছিলেন। এমন এক সময়ে শিক্ষিত ছিলেন যখন সমগ্র জনগোষ্ঠির ৯৫ শতাংশই ছিল অশিক্ষিত।

তারা অতি ধনীও ছিলেন না আবার অতি গরীবও ছিলেন না। ভদ্রোচিতভাবে জীবন যাপনের জন্য যা থাকা দরকার তার প্রায় সবই ছিল-নিজের বাড়ি ছিল, চাষ যোগ্য কিছু জমি ছিল আর ছিল প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা।

এমন কোন প্রমাণ নেই যে সীমার বাবা কখনও কিছু টাকা চেয়ে কারও কাছে হাত পেতেছিলেন।  কিন্তু অন্যদের সাহায্য করার মত তার যে একটা উপকারী মন ছিল তা প্রমাণ করতে পারে এমন অনেক লোক এখনও জীবিত আছেন।

উপকারের বিনিময়ে তিনি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হন নি ঠিকই তবে সবার কাছে তিনি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। এক সময় এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে আশেপাশের সাধারণ জনগণ তাকে রাজনৈতিক কোন নেতার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেনা করতে শুরু করেছিল। কারণেই তাকে এবং তার পুরো পরিবারকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এক প্রভাবশালী ক্ষমতাশালী নেতার রোষানলে পড়তে হয়েছিল। এই নেতা তাকে তার পথের কাঁটা হিসেবে ধরেও নিয়েছিল আর তাকে যেকোন উপায়ে নিশ্চিহৃ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। উদ্দেশ্যে সেই নেতা সবকিছু করেছিল কিন্তু নিশ্চিহৃ হওয়ার আগেই সীমার বাবা তা বুঝতে পেরেছিলেন এবং যত দ্রুত সম্ভব পরিবার সহ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জন্য খুব বেশি সময়ও নেননি তিনি। হঠাৎ করেই একদিন পরিবার নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন। কেউ জানত না কোথায়। হয়তো বা কোন শহরে। এমন ধারণাই করেছিল সবাই।

গ্রাম ছাড়ার পর থেকে সীমাকে আর কোন দিনও এলাকার কোথাও দেখিনি।

অবশ্য আমিও জীবনের শুরুতেই গ্রাম ছেড়েছি। তারপর থেকেই বিভিন্ন শহরে, নগরে, বন্দরে আছি। কিন্তু সীমাকে আর দেখিনি কোথাও।

একদিন আমার এক বন্ধুকে মোটর সাইকেল দূর্ঘটনায় মারাত্বকভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। ওর স্ত্রীর কাছ থেকে খবরটি প্রথম শুনে কি করব আর কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষে হাসপাতালে ছুটে গেলাম।

পৌঁছার আগেই বন্ধুকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে। সেই মূহুর্তের অবস্থা কি তা জানার জন্য ওর স্ত্রীর সাথে কথা বলছিলাম। বা মিনিটের মধ্যেই দেখলাম একজন সেবিকা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতেই প্রশ্ন করল, “হাই, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না?”

না তো! একদমই না। দুঃখিত। আমি উত্তর দিলাম

আমি সীমা, সেই সীমা যার সংগে তুমি পড়াশুনা করতে। এখন আমি এই হাসপাতালের একজন সেবিকা।সীমা বল্ল।

আমি চিনলাম এবং কথা বলা শুরু করলাম।

কিছুক্ষণ পর সীমা ওর হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিয়ে আমাকে অপেক্ষা করতে বা ওকে অনুসরণ করতে বল্ল। কারণ তখন এক নবজাতক শিশুর মাকে দেখতে যেতে চাচ্ছিল। সেই মা প্রথম বারের মত এক ছেলে সন্তানকে জন্ম দিয়ে তখন ভীষন অসুস্থ্য।

সীমা অতি উৎসাহের সাথে জানাল নবজাতক শিশুটির মা ওই একই গ্রাম থেকে এসেছে যে গ্রামে একদিন অন্যান্যদের মতই সীমা আমিও জন্ম নিয়েছিলাম এবং কৈশর পর্যন্ত থেকেছিলাম।

জানতে অস্থির হয়ে অতি আগ্রহে প্রশ্ন করলামকে সে”?

বলছি, এস আমার সাথে।

আমি ওর সংগে সংগে যেতে লাগলাম।

একেবারে দক্ষিণের বিশেষ একটি কেবিনে ছিল রুগিটি। হেঁটে গেলে মাত্র তিন মিনিটের দূরুত্ব।

বেহুশ হয়ে পড়ে আছে রুগিটি আশে পাশে বিভিন্ন নামের আর বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অসংখ্য ওষুধ। আমি সহজেই বুঝতে পারলাম ভীষন অসুস্থ্য সে। কিন্তু চিনতে পারলাম না।

কে সে”? আবারও প্রশ্ন করলাম আমি

সীমা বলতে শুরু করল কিন্তু শেষ করতে পারল না। তার আগেই আমি বুঝতে পারলাম মহিলাটি সেই নেতার ছেলের বউ যে সীমা এবং তার পরিবারকে এক দিন গ্রাম ছাড়া হতে বাধ্য করেছিল।

সীমা, তুমি জান …”?

সীমা সাথে সাথেই বলে উঠল, “হ্যাঁ, জানি। স্মৃতিতে সবই আছে। রাগ, ক্রোধ, ক্ষোভ এখনও জ্বালায়। প্রতিশোধের আগুন রাত, দিন সব সময় তাড়িত করে। সময় এখন আমার হাতে।  ইচ্ছে করলেই আমি প্রতিশোধ নিতে পারি। মা সন্তান উভয়কেই শেষ করে দিতে পারি। কিন্তু আমি একজন মেয়ে আর একজন সেবিকা। বিশ্বের সকল মেয়েদের মত, সকল সেবিকাদের মত আমিও বিশ্বাস করি জীবনের জন্যই জীবন কিন্তু মৃত্যুর জন্য নয়।

আরও কিছু বলবার আগে বাইবেলের মথি পুস্তকের ৫:৪৪ পদে লিখিত পদটি হুবহু মনে পড়ে গেল। এখানে লেখা আছে, “ কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, তোমাদের শত্রুদেরও ভালবাসো। যারা তোমাদের প্রতি নির্যাতন করে তাদের জন্য প্রার্থনা করো।”

এটি শিক্ষা না কি নিদের্শনা বিষয়টি বড় নয়। বড় বিষয়টি হচ্ছে প্রভূ যীশু খ্রিস্ট নিজেই তার শিষ্য বা অনুসারীদের এটি করতে বলেছেন। কিন্তু এটা বলতেই হয় খ্রিস্ট ভক্ত কোন মানুষের জীবনেও এই শিক্ষার তেমন একটা প্রতিফলণ আমি দেখেছি বলে আমার মনে পড়ে না।

সীমা হিন্দু ধমের্র অনুসারী বলেই আমি জানতাম। তবে আজ ও কোন ধর্ম পালণ করে আমি জানি না। আর তা জানাটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে শত্রুকে যে সত্যি সত্যিই ভালবাসা যায় এবং কিভাবে শত্রুকে ভালবাসা যায় সীমা নিজেই তার জীবন্ত ও জ্বলন্ত উদাহরণ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন